রবিবার, ৮ মার্চ, ২০১৫

রোদের মত রূপবতী

রোদের মত রূপবতী
১।
বাইরে অনেক ঝড়বৃষ্টি। দ্রিম-দ্রাম বাজ পড়ছে, বিজলি চমকাচ্ছে। কোথাকার যেন ছাদ ঢালাইয়ের টিন ওড়ার ঠন ঠন শব্দ ভেসে আসছে। বাতাসের চোটে ঘরের পাশে নারকেল গাছটার এলোপাতাড়ি নড়াচড়ার শো শো আওয়াজ বড়বেশি কানে লাগে। বাড়ির দরজা জানালা সব বন্ধ, তবুও। আর মাথার উপর চালে বৃষ্টির একটানা ঝমঝম তো আছেই। এত শব্দের মধ্যে রিনির আসোলে পড়তে ইচ্ছে করছে না, মনোযোগ নেই। সোজা কথায় ঘুম আসছে। ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশ, লোডশেডিং, কাথা একটা জড়িয়ে আরাম করে ঘুমাতে পারলে বেশ হত। কিন্তু আপাতত এই ঘুমের চিন্তা ভুলেও মাথায় আনা যাবে না, কারণ মাত্র ৬ দিন পর এইচ.এস.সি পরীক্ষা। প্রথম পরীক্ষা বাংলা ১ম পত্র। রিনি পিরোজপুর সরকারি কলেজ থেকে পরীক্ষা দেবে। কমার্সের ছাত্রী হিসেবে সে মোটেই ভাল না। এস.এস.সি তে পেয়েছিল "এ মাইনাস"। এবারও হয়ত কোনমতে পাশ করে যাবে। তবে লেখাপড়া বিষয়ে কোন উল্লেখযোগ্য গুন না থাকলেও ওর সবচেয়ে বড় গুন হল, ও অসম্ভব রূপবতী এবং সাংসারিক একটা মেয়ে।
ধুপ করে বই উল্টে মোমবাতিতে ফুঁ দিয়েই রিনির হঠাৎ মনে হল, ভুল হয়ে গেছে। কয়টা বাজে দেখা দরকার ছিল। যদি দশটার বেশি বাজে তাহলে আব্বা তেমন কিছু বলবে না। কিন্তু দশটার আগেই যদি দেখেন রিনি পড়া ছেড়ে উঠে পড়ছে, তখন প্রথমেই তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে আম্মার কাছে যাবেন তারপর শুরু করবেন সেই একই চ্যাচানি।

"রুমির মা, তোমার ছোট মেয়ে তো কথা শোনেনা। সে কি এবারও মাইনাস মার্কা রেজাল্ট নিয়ে আত্মীয়স্বজনের কাছে আমারে লজ্জা দিতে চায়? জিজ্ঞেস করো জিজ্ঞেস করো তাই চায় কিনা। উত্তর হ্যা হইলে এক্ষুনি জব্বারকে ফোন কইরা বিয়ের তারিখ দিতে বলবো। ঐ মেয়েরে দিয়া লেখাপড়া হবে না! তারচেয়ে পরের ঘরে হাড়িপাতিল মাজুক, বাচ্চাকাচ্চা পালুক, এইটাই ওর জন্য ঠিকাছে। কিযে পাপ করছিলাম, দুইটা মেয়ের একটারেও উচ্চ শিক্ষিত বানাইতে পারলাম না। অযথাই টাকা ঢালছি!"
তার এমন কথাবার্তার ধরন শুনলে মনেহয় পরীক্ষা রিনি না, রিনির আম্মাই দেবে। অথচ আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, তিনি এরকম ধমক দিয়ে কথা রিনির সামনে কখনোই বলতে পারেন না, এমনকি বড় মেয়ে রুমিকেও না। যা বলার সব ঝাড়েন ওদের আম্মার কাছে, পরবর্তীতে আম্মা আবার সেই কথাগুলো আস্তে ধীরে পৌঁছে দেন দু'বোনের কানে। রিনির কাছে ব্যাপারটা ভয়ানক হাসির লাগে, কখনো সখনো হেসেই ফেলে। আম্মা, রুমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে আর ও ওড়না চেপে হাসে।
রুমি শ্বশুড়বাড়ি চলে যাবার পর থেকে অবশ্য রিনি একটু বেকায়দায়ই পড়েছে বলা যায়। গল্প করার মানুষ নাই। আম্মা খালি সারাদিন এটা ওটা কানের কাছে প্যানপ্যান করতেই থাকে। এক নিজের প্যানপ্যান, দুই আব্বার প্যানপ্যান। এত প্যানপ্যানানি শোনা আর ভাল্লাগেনা। রিনির হঠাৎ হঠাৎ তাই বড় অভিমান হয়। অভিমানের বেশিরভাগ সময় সে কাটায় সম্পূর্ণ অচেনা অদেখা রাশেদ ছেলেটাকে ভেবে, যার সাথে ওর বিয়ে হবে। আব্বার স্কুলবেলার বন্ধুর ছেলে, ভাল চাকরি করে। আংটি পড়িয়ে গেছে, পরীক্ষার পর বিয়ে। রিনির খুব ইচ্ছে মানুষটাকে চোখ ভরে দেখার। আংটি পড়াবার দিন রাশেদের মা ওর গালে কপালে খুব আদর করে কেঁদে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন, "তোমাকে দেখে ভারি হিংসা হচ্ছে মামণি। জানো আমাদের বংশে এত সুন্দরী বউ কখনো আসে নাই। নিশ্চই আমার ছেলেটা কোন বড় পুণ্য করছে, যার পুরস্কার আল্লাহ আমাকে দিছে। আল্লাহর পুরস্কার বড় সুন্দরগো মামণি, বড়ই সুন্দর।"
কি সরল একজন মহিলা, কি ভাল। কথায় একদম মায়া ধরে যায়।
শফিক সাহেব ড্রয়িংরুমে সোফার উপর আসন করে বসে আছেন চোখ বন্ধ অবস্থায়। এতক্ষন মোমবাতির আলোয় একটা ইসলামী বই পড়ছিলেন। কম আলোতে চোখ কুচকে পড়তে পড়তে মাথা ধরে গেছে। ঝড়বৃষ্টি কমার নাম নেই, কারেন্টেরও খবর নেই। খেতে বসা দরকার, সময় তো আর থেমে নেই, রাত ঠিকই বাড়ছে। চট করে উঠে মোমবাতিটা নিয়ে বেডরুমে যাবার পথে খেয়াল করলেন ছোটমেয়ের ঘর অন্ধকার। তিনি আস্তে আস্তে রুমে এলেন মোমবাতি হাতে। দেখেন রিনি টেবিলে হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। শ্বাস টানার শব্দে বোঝা যায় গভীর ঘুম। শফিক সাহেবের মায়া লাগল। মেয়ের মাথায় আলতো করে দুবার হাত বুলিয়ে দিলেন। এই মেয়েটা তার বড় আদরের, যদিও একথা আজ পর্যন্ত কারো কাছে বলতে পারেন নাই। কিন্তু তিনি ঠিক করে রেখেছেন, বিয়ের দিন রাশেদের হাতে হাত ধরিয়ে দেয়ার সময় অবশ্যই রাশেদকে বলবেন; বলবেনই।
২।
খোলা দরজা দিয়ে কয়েক সারি ঝকঝকে রোদ ড্রয়িংরুমের ফ্লোরে ছড়িয়ে আছে, আরও কিছুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে তার আভা। শফিক সাহেব সে রোদের ভিতর ফ্লোরে আরাম করে বসে পত্রিকা পড়ছেন। সুন্দর সকাল। গতরাতের তুমুল ঝড়বৃষ্টিতে আকাশ এখন একদম পরিষ্কার। বাসার সামনে ছোট্ট উঠোনে ভাঙ্গা ডালপালা, ময়লা-টয়লায় ভর্তি। নাহলে তিনি ওখানেই চেয়ার পেতে বসতেন। দারুণ রোদ, গায়ে মাখানো দরকার ছিল।
"তুমি এখনো যাওনাই?"
স্ত্রী সামিনার রাগত স্বরে শফিক সাহেব মুখ তুলে চাইলেন। তাকানোর ভঙ্গি এমন যেন কিছুই জানেন না। আস্তে বললেন, "কই যাবো?"
"জাহান্নামে যাও! নাস্তা খাওয়ার সময় যেন চা চা করতে না শুনি বইলা দিলাম।"
গজগজ করতে করতে সামিনা চলে গেলেন। ঘরে চা-পাতা নেই, কয়েকবার এসে বলে গেছিলেন চা আনার কথা। কিন্তু কে শোনে কার কথা, শফিক সাহেব তার পত্রিকা নিয়েই মহাব্যস্ত। যদিও ঘরে চা খাওয়ার মানুষ একমাত্র তিনিই। রিনি খায় ঠান্ডা কাশি লাগলে।
ইট গাথা রাস্তার ভেজা ফুটপাত দিয়ে সাবলিল ভঙ্গিতে পা ফেলে হাঁটছেন শফিক সাহেব। আসবেন না আসবেন না করে অবশেষে বেরিয়েই পড়লেন চা কিনতে। চা ছাড়া সকালের নাস্তা কেমনজানি অসম্পূর্ণ লাগে, মনেহয় কি যেন একটা খেতে বাকি। হাঁটতে হাঁটতে পরিচিত কয়েকজনের সাথে গতরাতের ঝড় নিয়ে টুকটাক কথা হল। জসিম বিরানী হাউজের টিনের ছাউনি উড়ে গেছে, আশা ফার্মেসির মোড়ে বিরাট এক শুকনো নারকেল পাতা উল্টে রাস্তা ব্লক, মোবারক ডাক্তারের ঘরের সামনে দুইটা মরা কাক পড়ে আছে তবে একটা এখনো পা নাড়ায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। এরকম আরও খুটিনাটি ঘটনা বেশ গুরুত্বের সাথেই শোনেন শফিক সাহেব। আপাতত তিনি একা। কাছের সবকটা মুদি দোকান বন্ধ থাকায় সিদ্ধান্ত নেন আরেকটু সামনে যাওয়া যাক। ইটের রাস্তা ছেড়ে পিচঢালা রাস্তায় পা রাখতেই হঠাৎ ওপাড়ে রিকশা থেকে নামতে থাকা দুজন মানুষ চোখে পড়ে। কয়েক সেকেন্ড ভালমত দেখেই চেহারায় একইসাথে বিস্ময় এবং আনন্দ ফুটে ওঠে তার। বড় ছেলেটা তো রাশেদ, বন্ধু জব্বারের ছেলে। কিন্তু সাথের ছোট ছেলেকে চিনতে পারছেন না। ইতিমধ্যে রাশেদ তাকে দেখতে পেয়েছে, হাসিমুখে দ্রুতপায়ে এগিয়ে এলো। হবু শ্বশুড়ের পা ছুঁয়ে সালাম করবার আগেই তিনি ওকে ধরে আনন্দমাখা কন্ঠে বলে উঠলেন, "কেমন আছো রাশেদ? তুমি কি আমার বাসায়ই যাচ্ছিলে?"
"জ্বি আংকেল। অফিস কামাই দিয়ে এসেছি।" হাসিমুখেই বলল।
"অফিস কামাই দিয়ে আসছো? তুমি তো নিজ ইচ্ছায় আসো নাই বোঝা যায়। কে পাঠাইছে, জব্বার?"
"জ্বি না, মা। পাঠানোর কারণও উদ্ভট। বিস্তারিত না বললে বুঝবেন না।"
"তাইলে জলদি চল। গাধার মত তোমাকে রাস্তায় দাড় করাইয়া কথা শুরু করছি, ছিঃ ছিঃ।"
রাশেদ একটা লাজুক হাসি হেসে হবু শ্বশুড়ের সাথে পা বাড়ায়। একপর্যায়ে শফিক সাহেব ছোট ছেলেটাকে দেখিয়ে বলে উঠলেন, "তা বাবা সাথে এইটা কে? কি শান্তশিষ্ট হাঁটতেছে।"
"ও আমার ভাগ্নি, আংকেল। বড় আপার ছেলে। নিয়ে আসতে চাই নাই, মা জোর করে দিয়ে দিছে। সারাদিন ঘরে আটকা থাকে তো, একটু ঘুরাতে বলল আরকি।"
"হ্যা খুব ভাল করছো নিয়ে এসে। রিনি দেখলে খুশি হবে, ছোট বাচ্চাদের ও খুব পছন্দ করে।"
রাশেদ হেসে চুপ করে থাকে। সম্ভবত রিনির কথা তোলায় খানিক অস্বস্তিবোধ করছে, আবার ভালও লাগছে। সত্যি কথা বলতে কি, শুধুমাত্র মায়ের কারণেই যে এখানে এসেছে, তা নয়। রিনিকে একনজর দেখার ইচ্ছাটাও ভিতরে ভিতরে পাগল করে তুলছে। একজন মেয়ে এতটা রূপবতী কিভাবে হতে পারে ওর জানা নেই।
৩।
পর্দার ফাক দিয়ে খুব সাবধানে রাশেদের খাওয়া দেখছে রিনি। টুকরো করে ছেড়া পরোটায় সামান্য ভাজি মাখিয়ে তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছে। আহারে বড় মায়া লাগে, খুব খিদে লেগেছিল বুঝি। ভেবেছিল, নাস্তাপানি এগিয়ে দেয়ার সুযোগে যদি একটু সামনে যাওয়া যায়। হল না, ওকে চুলার কাছে বসিয়ে আম্মাই ছুটলেন। রিনি বেচারি মুখ কালো করে পড়ার অযুহাতে চলে এসেছে। এসে দাড়িয়ে আছে এখানে। গলার ভাজে পরম মমতায় গুজে রাখে আংটি পড়া হাতটা। বেশিক্ষন অবশ্য দাড়াতে পারলো না, এখনই আম্মা আসবে। দেখে ফেললে ভীষণ লজ্জায় পড়ে যাবে।
শফিক সাহেবের খাওয়া আগেই শেষ। তিনি মাত্র একটা ঢেকুর তুললেন। রাশেদ পানি খাচ্ছে। সামিনা এলেন প্লেট বাটি নিয়ে যাওয়ার জন্য। হঠাৎ নিচু স্বরে স্বামীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, "চা-পাতা আনছো?"
"আনতে বের হইছিলাম তো। কিন্তু পথে ওদের সাথে দেখা হল, আর খেয়াল ছিল না।"
"কথা বললে তো শুনবা না! এখন জামাইকে চা দিব কেমনে?"
রুমালে ভাগ্নির মুখ মুছতে মুছতে রাশেদ হাসিমুখে বলল, "আন্টি আমি চা খাইনা। আপনি ব্যস্ত হয়েন না, বসেন। মা যে কারণে পাঠালো সেটা এখন বলি।"
কয়েক সেকেন্ড দম নিয়ে তারপর শুরু করে।
"গতরাতে আমাদের ওদিকে দারুণ ঝড় হইছে।"
মাঝ দিয়ে শফিক সাহেব আবার বলে ওঠেন, "অ, ঝালকাঠিতেও ঝড় হইছে তাহলে? এইখানেও তো, বুঝলা।"
"জ্বি। মা আবার এত ঝড়বৃষ্টি ভয় পায়। খালি দোয়া ইউনূছ পড়ে, তার অভ্যাস। বিছানে বসে পড়তে পড়তে একসময় গেছে ঘুমিয়ে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছে - চারপাশ পানিতে থইথই, বন্যার মত অবস্থা। অন্ধকারে কিচ্ছু দেখা যায় না, শুধু ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। বিজলি আলোয় হঠাৎ দেখে একটা বাড়ি, পাশে একটা নারকেল গাছ। প্রচন্ড বাতাসে গাছের মাথা বাড়ির চালে একবার আছাড় খায় আবার সোজা হয়, এমন চলতেই আছে। হঠাৎ দেখে বাড়িটা নাই গাছ আছে। তারপরই ঘুম ভেঙ্গে গেল। এই স্বপ্ন দেখে মা ভয়ে অস্থির। বাড়ির পাশে নারকেল গাছ, আপনাদের সাথে তো মিলে। ঝড়ের রাতেই এই মন্দ স্বপ্ন দেখল, ভাল লক্ষণ না, আপনাদের কোন বিপদাপদ হল নাকি। ভোর থেকে যে শুরু করছে চিল্লাপাল্লা, তারপর আমাকে ধরেবেধে পাঠিয়ে দিছে। বলছিলাম ফোন করে খবর নিতে, ধমকে উঠছে। মূলত এজন্যই হুট করে আসা। এখন যাওয়া দরকার।"
সামিনা আচল দিয়ে চোখ মুছলেন। শফিক সাহেব নির্বিকার। বন্ধুর স্ত্রী সম্পর্কে তিনি অবশ্য কম জানেন না। জব্বারের মুখে বহু শুনেছেন, নিজ চোখে দেখেছেন। তাই বলে আজকের মত এতটা কখনোই কল্পনা করেননি। মাঝে মাঝে মনেহয়, এমন ভাল মানুষগুলো বেঁচে আছে বলেই হয়ত জগতে মায়া শব্দটাও বেঁচে আছে। ভাল মানুষ শেষ, মায়াও শেষ।
৪।
সামনের রাস্তায় স্কুলড্রেস পড়া কতগুলো পিচ্চি ছেলেপেলে দুষ্টুমি করতে করতে যাচ্ছে। একজন আরেকজনকে মেরে দিল দৌড়। রাশেদের ভাগ্নি চোখ বড় বড় করে তাদের দেখতে থাকে, রাশেদ ওর আঙ্গুল ধরে দাড়ানো। এখানে ওখানে জমাট বাধা বৃষ্টির পানিতে স্বচ্ছ রোদের চিকিমিকি, তাকিয়ে থাকতে ভালই লাগে। পানির উপর ভাসমান বিন্দুর মত ছোট ছোট পোকা।
দুজন উঠোনে দাড়িয়ে আছে শফিক সাহেবের অপেক্ষায়। তিনি ওদের বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দেবেন বলে পাঞ্জাবী বদলাতে গেছেন। প্রথমত খেয়াল না করলেও রাশেদের চোখে হঠাৎ ধরা পড়ল রিনি দরজায় দাড়িয়ে আছে। একগুচ্ছ রোদ ওর মুখ বরাবর, মাথায় সুন্দর করে ওড়না দেয়া। রাশেদ হাত নেড়ে ডাকল। খানিকক্ষন চুপ থাকার পর রিনি বেশ দ্রুত পায়ে ওর একহাত সামনে এসে দাড়ায়। মুখটা সামান্য নুইয়ে আছে। রাশেদ সরাসরি বলল, "তুমি কি লজ্জা পাচ্ছো রিনি?"
"একটু একটু। আপনি ভাল আছেন?"
কথাটা বলেই ও মুখ সোজা করে, রাশেদের চোখে তাকায়। সাধারণ পুরুষসুলভ চোখ, আকর্ষণ হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু ও সাথে সাথে নামিয়ে নিতে পারে না, কেন জানি। না পারে রাশেদ, না পারে ও। নিরিবিলি এভাবেই কেটে যায় কিছুক্ষন; বড় মূল্যবান কিছুক্ষন। একসময় রাশেদই দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়, অস্বস্তি লাগছে। রূপবতী মেয়েদের চোখে চোখ রেখে তাকানো জগতের অন্যতম কঠিন কাজগুলোর মধ্যে একটা। সব পুরুষ কিংবা ছেলের এই কঠিন কাজটা করার সাহস থাকে না। রাশেদেরও এখন নেই, তবে একসময় হবে।
"চুপ করে আছেন যে? আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না?"
রিনিই এবার আগ বাড়িয়ে কথা বলে। রাশেদের অস্বস্তিভাব বুঝতে পেরে ওর ভীষণ হাসি পাচ্ছে। বলতে ইচ্ছে করছে, "আপনি তো আচ্ছা লাজুক মানুষ! যে আপনার অর্ধেক বউ হয়েই গেছে তার সামনে এখনি এই অবস্থা, তাহলে বাসররাতে কি করবেন শুনি? ফিট হয়ে পড়বেন? সমস্যা নাই, আমি মাথায় পানি ঢেলে দিবনে।"
"এক গ্লাস পানি খাবো, আনতে পারবে?" মিনমিনে গলায় রাশেদ বলে ওঠে।
"পারব না কেন, আনছি।"
রিনি পানি নিয়ে আসে, ঢগঢগ করে খেয়ে খালি গ্লাসটা ওর হাতে দিয়ে রাশেদ বলল, "তুমি চোখে কাজল দাওনা?"
"অনেক কম। ঘরের মধ্যে দিয়ে কি হবে, তাই দেইনা।"
"বিয়ের পর থেকে রোজ গোসল শেষে দেবে, কেমন?"
"আচ্ছা।"
"তোমাকে দেখতে তখন ভারি সুন্দর লাগবে।"
"আমি এখন যাই?"
"যাও। আর শোন, তোমার আব্বাকে একটু জলদি করতে বল।"
মাথা সামান্য ঝাকিয়ে রিনি আস্তে দরজার দিকে পা বাড়ায়। বহুদিন পর মনটা আজ অসম্ভব ভাল লাগছে, অনেক খুশি। যদি সুযোগ থাকত তবে এখনই রাশেদের দুহাত ধরে ইচ্ছামত ঘুরে ঘুরে নাচত সারা উঠোনভর। চোখে থাকত কাজল, হাতে একঝাক কাচের চুড়ি, চুলগুলো খোলা। চিৎকার করে বলত, "এই রাশেদ, বল তুমি আমার কাছে কি চাও? যা চাইবে সব দেবো, সব!"
রহস্যময় এই জগতে আমরা মনের অনেক টুকরো টুকরো ভাল লাগার কথাগুলো মুখ ফসকে বলে ফেলতে পারিনা। সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির সাথেই যেটা ঘটে আরও বেশি। কিন্তু বিধাতার রহস্যই যে এখানে। এই বলতে না পারা টুকরো কথাগুলোর মধ্যে তিনি মিশিয়ে রেখেছেন অসীম মায়া; যার সূচক কেবল উপরেই ওঠে, নিচে নয়।

Post Comment

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন