শনিবার, ২৮ মার্চ, ২০১৫

একটা নীল আকাশ, চার রঙা মেঘ

১।
রুমটা একদম অন্ধকার। চারপাশ মশা আর হাবিজাবি লক্কর-ঝক্কর জিনিসে ভর্তি। হলের স্টোররুম তো, তাই। টিউবলাইট যদিও একটা আছে কিন্তু তা জ্বালাবার কোন চান্স নেই। ছেলেগুলো পিয়াল আর দিপুকে ধাক্কা মেরে ফেলে যাবার সময় সুইচবোর্ডের কাটআউটসুদ্ধ খুলে নিয়ে গেছে। ইচ্ছামত চড় থাপ্পড় ঘুষি দিয়েও তৃপ্তি মেটে নাই, আবার এই অসহ্য টর্চারিং। ফলাফল, শীত শীত গুমোট অন্ধকারে বসে আপাতত ঠাস-ঠুস মশা মারা। দিপু ঠিক তাইই করতেছে, আর মাঝে মাঝে কি যেন গুনগুনায়। পিয়াল চুপচাপ। ওর নিচের ঠোঁট অনেকখানি কেটে গেছে, রক্ত জমাট। টের পায় কয়েকটা মশা বসছে রক্তের উপর। দিপুর কি অবস্থা জিজ্ঞেস করেনি। ঠোঁট একটু নাড়ালেই কাটা জায়গায় জ্বলে। ডানহাতের পাতা হালকা কাপতেছে, সম্ভবত অনেকগুলো মশা একসাথে কামড় বসানোর কারণে। দিপুর হঠাৎ কাশি ওঠে, জোরে জোরে দম লাগিয়ে কাশে। গলা উগড়ে কাশে আর থু ফেলে। পিয়ালের ধারণা, ঐ থু এর মধ্যে রক্তের ফ্যানাই বেশি।
শীতের রাত; একটু একটু করে সময়ের কাটা বেড়ে চলছে। পাশের রুমে ছেলেগুলোর উত্তেজিত গালিগালাজ শোনা যায়। ঠান্ডা দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে নর্মাল বসে থাকে পিয়াল, দিপু। কিছুক্ষন পর অথবা ভোর হবার আগেই ওদের মেরে ফেলা হবে, এটা ওরা ভালমতই জানে। হলশাখার সাধারণ সম্পাদক রাতুল ভাইকে ফোন দেয়া হয়েছে, সে এলেই ডিসিশন। কাজ শেষে তারপর ওদের লাশদুটো হয়ত ফেলে দিয়ে আসবে ভার্সিটির একদম পিছনের কোন এক চিপায়। কিংবা আসলামের লাশের মত পুরো উধাও করে নাটকীয় প্রতিবাদ সভা সাজিয়ে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে দোষ দেবে বিরোধী পক্ষের। যেটা ইচ্ছা করতে পারে। এদেশে এসবের নামই তো পলিটিক্স; পলিটিক্সের শিল্প।
দিপু মশা মারার একফাকে খেকিয়ে ওঠে, "ধুর! মেজাজ গরম লাগতাছে! ঐ পিয়াল, তোর কি মনেহয়? আমগো ডিরেক্ট খতম নাকি হাড্ডিগুড্ডি ভাইঙ্গা গলায় ঝুলাবে, হুম?"
- তোর বাচঁতে ইচ্ছা করতেছে, নারে দিপু?

ঠোঁট কাটা নিয়ে হাসার চেষ্টা করে পিয়াল। একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার বলে, "তোরে নাও মারতে পারে বুঝলি। রাশেদ ভাইরে গুলি করছি তো আমি, মিটিংয়ের সবাই দেখছে। কাজেই আমারেই খতম করবে, তুই বাইচা যাবি, টেনশন নিস না।"
দিপু কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে যায়, আসোলে ওর খুব সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়েছে। পিয়াল তো খায়না, বলে লাভ নাই। আসলামের হাসি হাসি মুখটা কেন জানি চোখে ভাসে হঠাৎ, অস্থির লাগে দিপুর। পরক্ষনেই ভেসে ওঠে রোকেয়া হলের মুন্নি মেয়েটার চেহারা; এবার ভাল লাগে, খুব ভাল। এক বছর ধরে খালি দেখে দেখেই গেল, কিছুই বলতে পারল না। হায়রে নিয়তি, বলা তো দূরের কথা, আর দেখাও হবে না এজনমে।
"ফোন আছেরে দিপু তোর কাছে?" পিয়ালের কথায় ঘোর ভাঙ্গে ওর।
- নাহ, কেন?
- মারিয়ার সাথে একটু কথা বলতাম।
- হুম, আমারও ইচ্ছা করতাছে। আসলামের মৃত্যুর খবর শোনার পর মুটকিটা কি কান্না কানছিল দেখছিলি? আমাদের কিছু হইলে ওতো মইরাই যাবেরে পিলু। মেয়েটা এত ভাল কেন?
দিপুর কন্ঠ ভয়ানক কাপছে। পিয়ালের চোখে পানি, কাটা ঠোঁটে বেখেয়ালি হাসি। একহাত দিয়ে খামচে ধরে দিপুর হাত। মারিয়া, আসলাম, দিপু, আর ও; কত কত মজা, কত্ত সুন্দর সময়, সাথে পাগলাটে বন্ধুত্ব। ইস! সব হারিয়ে যাবে, স....ব।
২।
আসলাম, পিয়াল, দিপু, আর মারিয়া। ভার্সিটিতে পরিচয় কিংবা মুখ দেখাদেখির আগ পর্যন্ত এই চারজনের মানসিক চিন্তাধারা ছিল একেবারে চৌরাস্তা টাইপ। মানে, একেকদিকে চলে যাওয়া চার রাস্তাগুলোর মত একদম আলাদা, অমিল। এই যেমন, আসলাম মাদরাসা থেকে পড়েছে বিধায় ওর একটু বেশিই ভদ্র ভাবভঙ্গি, অথচ দিপুটা হল এর পুরাই উল্টা; অতি চঞ্চল ফাজিল। ওদিকে পিয়াল আবার এই দুটোরই কম্বিনেশন কিন্তু, যা এককথায় প্রকাশ করলে দাড়ায় - "উপর দিয়া ফিটফাট, ভিতর দিয়া সদরঘাট"। বাকি থাকল এখন মারিয়া। সহজ সরল, শুটকি মার্কা, হাসিখুশি একটা মেয়ে; চোখে পড়ার মত তেমন বিশেষত্ব নাই। যেটা আছে তা হল, ওর বাবার অনেক টাকা।
তো চারজনের এই যখন অবস্থা, তখন তাদেরই মধ্যে আবার বেশ অল্প কদিনে দফারফা বন্ধুত্ব হয়ে যাওয়াটা চোখ হালকা কপালে তোলার কথা বটে। কে কেমন, কার অভ্যাস কি ছিল, এসব ভাবার আর সময় নেয় না কেউ। নিজেদের কাছে চারপাশের কাছে ওদের পরিচয় একদম স্বচ্ছ আকাশের মত একটাই হয়ে যায় - ভীষণরকম বন্ধু। তবে ফাজিল দিপু আর সেমি-ফাজিল পিয়ালের ভাষায়, "মারিয়া মুটকি আমাদের গার্লফ্রেন্ড এবং আমরা ওর অতি সম্মানিত বয়ফ্রেন্ড, কোন সমস্যা?"
বলতে বলতে মারিয়ার চুলে কয়েকবার যৌথ টান মারাও হয়ে যায়। আসলাম সম্মতির দাঁত ক্যালানো হাঁসে আর মারিয়ার কানে শিস দিয়ে বলে, "তোরে ইভটিজিং করছি মুটকি বেগম, হেহেহে! আহাহা, মেয়েদের কানে শিস দেয়ার কি যে শান্তি, কি রোমান্টিকতা!"
- দাড়া হারামি, তোদের আজ চুল টাইনা টাক্কু যদি না বানাইছি। শরীর আমার পুরা পাটকাঠি আর তোরা মুটকি মুটকি চিল্লাস! আমি মুটকি??
ওওওরে দুষ্টামি তিনটার! মারিয়াও কি কম? হাসতে হাসতে চান্সমত ফাজিলগুলার চুল টানতে দেয় ছুট। ঐ তিনটা দৌড়ায়, হাত একটা জাগিয়ে সেও। ভার্সিটির সবুজ ঘাসের মাঠে ধুমধাম ছোটাছুটি, যেন চারজনই সেই হাফপ্যান্ট-ফ্রক কালের পিচ্চি হয়ে গেছে। আশপাশে থাকা সব ছাত্রছাত্রী, অন্যান্যরা ব্যস্ততার মাঝে খানিক হা করে ওদের কান্ড দেখে, অবাক হয়, মজা পায়, আরও কতকি।
এইতো এমনটাই কাটে ওদের, বলতে গেলে সারাদিনই। হল থেকে কোন কাজে বের হল একজন, পথে দেখা আরেকজনের সাথে। ব্যস্, ওখানেই শুরু এবং কাজ তখন গোল্লায়। অতঃপর একসময় হুট করে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে ওঠে, "ঐ দোস্ত, আমি যেন কি কাজে বাইর হইছিলাম?"
তারপর, রোজ বিকেলে চারজন এসে জমা হয় ভার্সিটি লাইব্রেরীর পিছনে ছোটখাট পার্কের মত যে জায়গা আছে। ওখানে ফুচকা চটপটির গাড়ি বসে অনেকগুলো। ছেলেমেয়ে বুড়োবুড়ি দলবেধে সব খায় আর গল্প করে। জমজমাট পরিবেশ, দারুণ লাগে মারিয়ার। সহ্য না করতে পেরে বলেই ফেলে, "আমাদের ক্যাম্পাসের চারপাশ কি সুন্দর, নারে পিলু? ভাগ্যিস এখানে চান্স পাইছিলাম।"
- এই খুশিতে আরেক প্লেট ফুচকার অর্ডার দে, কুইক। দিপুরে আর দিবি না, শালা দেড় প্লেট খাইছে! আসলাম আর আমারে দে।
ফুচকার ঝালে হু হা করতে করতে বলে পিয়াল। ওদিকে দিপু যায় ক্ষেপে, "আমি দেড় প্লেট খাইছি? চোখের সামনে এতবড় মিথ্যা অপবাদ! কেমনে কি!"
ভ্রু নাচিয়ে এবার আসলাম চিল্লায়, "অফ যা বেটা! আমগো প্লেট থেকে যে ছোঁ মাইরা কয়েক পিছ পেটে চালান দিছিস, ঐসব মিলাঝিলা হিসাবমতে তোর দেড় প্লেটই হয়। শালা রাক্ষস!"
আসলামের এমন ফাটাফাটি সাপোর্ট পেয়ে যেইনা পিয়াল তৃপ্তি সহকারে খিক খিক হাসতে যাবে তখনই মারিয়া কোর্টের জজ স্টাইলে টেবিলে দেয় দুই থাবা। ওরা চুপ এবং বুক টানটান অ্যাটেনশন। কোনমতে হাসি চেপে মারিয়া আস্তে বলল, "এখন আমরা হাঁটব।"
পার্কের কাছে একটা পিচের রাস্তা সোজাসুজি বহুদূর চলে গেছে। হঠাৎ তাকালে মনেহয় পথটা কত বড় কত অসীম। তার দুপাশ ঘিরে ইয়া মোটা মোটা কান্ডর সব গাছের সারি। টুকটাক রিকশা যায় টুংটাং শব্দে। কিছু প্রেমিক-প্রেমিকারা পরম স্নেহে হাত ধরে হাঁটে আর ভালবাসার কথা বলে। তাদের দেখতে দেখতে মারিয়া মুচকি একটু হাসে। ওর এই হাসি বাকিদের চোখে পড়ে না। কারো খেয়াল নেই কারো দিকে। হাঁটছে তো হাঁটছে। পাশাপাশি, কিন্তু মন যে এখন এদিক সেদিক। শেষ বিকেলের এই সময়টাই বুঝি এমন; এলোমেলো রকম। ইটের ছোট এক টুকরায় লাথি মেরে মেরে দিপু পা চালাচ্ছে, ওর ঘাড়ে হাত রাখা পিয়ালের, পাশে আসলাম এগোয় দুহাত পকেটবন্দি করে। মারিয়া একটু পিছে পড়ে আছে, ইচ্ছে করেই। একা একা হাঁটতেই ওর কেন যেন ভাল্লাগছে। কেন, জানেনা।
গাছগাছালির ফাক গলে গোধূলির শেষ আলোছটা জানান দিচ্ছে, এবার সন্ধ্যা হবার পালা। পাখিদের ডাক কমে আসছে ধীরে ধীরে। পড়ে থাকা ঝালমুড়ির ঠোঙা, বাদামের খোসা, চকলেট আইসক্রিমের প্যাকেট মাড়িয়ে ওরা তবু চলতেই থাকে সামনে।
৩।
দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল এমনই হরেকরকম কায়দায়। দেশের পরিস্থিতি আগের চেয়ে অস্বাভাবিক হয়ে উঠতে থাকে একসময়। রাজনৈতিক দলগুলোর খালি জেদাজেদি, মারামারি, হ্যানত্যান কর্মকান্ড। প্রতিদিন পত্রিকার প্রথম পাতায়ই থাকে একাধিক বাস-ট্রাক পোড়ার ছবি, ইনসেটে নিহতদের; যেন এটাই নর্মাল, এরকমই হবার কথা ছিল।
ইতিমধ্যে আসলাম, পিয়াল, দিপু মাতব্বরি খাটিয়ে পলিটিক্সে ঢুকে যায়। হলের বেশ ভাল খাতির জমানো কয়েক পলিটিক্যাল বড়ভাই ছিল, জাস্ট কোনরকম বলেটলে কাজ হয়ে গেছে। মিটিং মিছিল, সভা সমাবেশ সবখানে তিনজন শতভাগ উপস্থিত। ফলে হুট করে চারজনের সেই আগের মত আড্ডাবাজি কমে গেছে অনেক। মারিয়ার মন খারাপ যতটা হয়, তারচেয়ে বেশি লাগে ভয়। এইযে ওরা এত দৌড়াদৌড়ি করে, ভার্সিটির অবস্থাও গরম, হলগুলোয় তো মারামারি লেগেই থাকে, কখন কি হয়ে যায় তার ঠিক আছে? শের-এ-বাংলা হলের কোন একটা গ্যাঞ্জামের কথা কানে এলেই হার্টবিট ভয়াবহ বেড়ে যায়, ফাজিল তিনটাতো ও হলেই থাকে। ফোনের পর ফোন দিয়ে ওদের সাথে কথা বলার পর তবেই স্বস্তি। মাঝে মাঝে প্রচন্ড রাগ হয় মারিয়ার, কিসের দরকার ছিল এইসব হাবিজাবি পলিটিক্সে জড়ানোর? কি লাভ হয় এতে? আমাদের চারজনের সুন্দর ছোট একটা জগতের চেয়েও কি ঐ জগত বেশি সুন্দর?
নাহ, বহু ভেবেও এর কোন উত্তর পায়না। খালি ভিতর থেকে এক বাক্যের একটা সান্ত্বনা পায় - "একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।"
সময় ফুরাতে ফুরাতে দিন, মাস কেটে যায়। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা শেষ। আসলাম, পিয়াল, দিপুদের তো দম ফেলার ফুসরত নেই, মহাব্যস্ত এখন। হল সভাপতি রাশেদ ভাই আর সাধারণ সম্পাদক রাতুল ভাইয়ের কথামত প্রায় প্রতিদিনই ক্যাম্পাসের আশেপাশে ছাত্রসভা করে চলে ওদের পুরো টিম, আর রাতে হয় সব সিনিয়র জুনিয়র কর্মীদের নিয়ে দলীয় মিটিং। উপর মহলের চাপে রাশেদ ভাইয়ের অবস্থা পুরা কেরোসিন। রাগ অলটাইম একশো ডিগ্রী উঠে থাকে। ঐ সেদিন রাতেও মিটিংয়ের মাঝখানে উঠে কয়েকটারে থাপড়াইছে। পরিস্থিতি বড়ই হযবরল।
রাত সোয়া ১০টা। সারাদিনের খাটাখাটনিতে আসলাম, পিয়াল, দিপু হাপিয়ে উঠেছে একেবারে। আজকে ওদের মিটিং-এ আসার কোন ইচ্ছা ছিল না, মারাত্মক ক্লান্ত লাগতেছে। ঘুমে চোখ ঢুলুঢুলু। দেরিতে আসছে বলে বসার জন্য চেয়ারও পায়নি, দাড়িয়ে আছে। রাশেদ ভাই কিযে একই বকবক করে প্রত্যেকটা দিন, বিরক্তিকর!
"ঐ আসলাম ঐ, ঐ ব্যাটা এদিক তাকা!" রাশেদ ভাইয়ের হঠাৎ কড়া ধমকে আসলামসুদ্ধ সব নড়েচড়ে উঠেছে। ঘুম-টুম উধাও।
"জ্বি ভাই।" মিনমিনিয়ে বলে আসলাম।
- কুত্তার বাচ্চা চড়াইয়া তোর কান ফাটাইয়া ফালামু, হারামজাদা।
- কি করছি আমি?
- খানকির পুলা, আবার মুখে মুখে কথা কস! এইখানে কি ঘুমাইতে আইছস? কাজের কথা কইতাছি, ভাল্লাগেনা? কুত্তার বাচ্চা!
- ঐ মিয়া, আস্তে গালি মারেন। খাটাখাটনি কম করিনা, আপনে তো খালি অর্ডার দিয়াই খালাস। আমরা পোলাপান গরুর মত খাটি আর আপনে কি? জমিদারের মত সিগারেট টানেন আর টাকা গুনেন! পারলে একটু কাজে নামেন, দ্যাখেন ঘুম কেন আসে!
পুরো রুমে আপাতত পিনপতন নিরবতা, টুটা শব্দ নেই। রাশেদ ভাই তো বটেই, সমস্ত ছেলেপেলে ভয়ানক চমকে গেছে। আসলাম একটানে কথাগুলো কোন সাহসে কেমনে বলল, কারো মাথায় ঢুকছে না। এদিকে পিয়াল দিপুর মুখ হা, চোখে গাঢ় আতঙ্ক। তার ঠিক কয়েক মিনিট পরেই রুম কাপিয়ে দুটো গুলির শব্দ হল। কানের পর্দায় বিশাল ঝাকি খেল সবাই। রাশেদ ভাই কখন পিস্তল হাতে নিয়েছে, আর কখনইবা শ্যুট করেছে কেউ যেন টেরই পেল না। চোখের পলকে ঘটে গেল ঘটনাটা। আসলাম ফ্লোরে লুটিয়ে আছে, বুকের কাছে খয়েরি রঙা শার্ট চুইয়ে রক্তের প্রবাহ আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। চোখদুটো ওর খোলা, তাতে ক্লান্তির ছাপ এখনো স্পষ্ট। সারারুমে ইতিমধ্যে বহুজনের বহু কথাবার্তা কানাকানি শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু পিয়াল এবং দিপুর কানে তার একটা শব্দও পৌঁছে না। একবার কেবল রাশেদ ভাইকে দেখে, তারপর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে প্রিয় বন্ধুর গড়িয়ে চলা রক্তে। টিউবলাইটের সাদা আলোয় রক্তের রঙটাও আসলামের শার্টের মত খয়েরি দেখাচ্ছে।
পাঁচ দিন পর।
সময়টা ভরদুপুর। পরিত্যক্ত একটা মালবাহী বগির দরজায় পা ঝুলিয়ে পিয়াল বসা। দিপু মারিয়া বসে আছে ওর বরাবর রেললাইনের উপর। জায়গাটা স্টেশন থেকে খানিক দূরে। আর আধঘন্টা পর মারিয়ার ট্রেন। সে অপেক্ষাতেই তিনজন। চুপচাপ বসে আছে শুধু, কেউ কিচ্ছু বলছে না। যে মানুষগুলো একসাথে থাকা মানেই বিরতিহীন হাসি-আড্ডার ফোয়াড়া ছোটানো, অথচ তারাই কিনা আজ কথা বলে না, ইচ্ছেমত হাসে না, চুল টানাটানি করে না, গলা মিলিয়ে গান ধরে না।
আচ্ছা, আসলাম কি ঐ আকাশ থেকে দেখতে পাচ্ছে ওদের? বুঝতে কি পারছে, ও না থাকায় কত ভয়ানক হাহাকার জড়িয়ে ধরেছে ওদের? কে জানে, হয়ত হ্যা হয়তবা না।
মারিয়া হঠাৎ ব্যাগ হাতে উঠে দাড়ায়, চলে যাবে। ধরা গলায় বলল, "গেলাম।"
- বাসা দিয়ে ফিরবি কবে?
- জানিনা। দেখি, মন একটু হালকা হলেই চলে আসব। তোদের ছেড়ে তো আর থাকতে পারব না।
লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মারিয়ার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে দিপু এবার পিয়ালের দিকে তাকায়। কদিনে ছেলেটার মুখ কেমন শুকিয়ে গেছে, চোখের নিচে কালি, ঝিমুনির মত বসে থাকে সবখানে। রেললাইন থেকে একলাফে পিয়ালের কাছে এসে ওর ঘাড়ে হাত জড়িয়ে দৃঢ় স্বরে বলল, "রাশেদরে মারব, ডিরেক্ট খতম। রাজি?"
- কেমনে?
- আজ রাতে মিটিংয়ে। পিস্তল জোগাড় করছি।
কোনপ্রকার অবাক কিংবা সামান্য কৌতুহলবশে বিস্তারিত কিছুই পিয়াল জানতে চাইল না। বরং ঠান্ডা দৃষ্টি মেলে দিপুর চোখে তাকিয়ে বলে দিল, "রাজি।"
রুমে রোজকার মত সবাই উপস্তিত। পিয়াল দিপুর অনুপস্থিতি কারো খেয়ালে নেই। ঘড়িতে সময় রাত সাড়ে নয়টা। মিটিং শুরু হয়েছে মাত্র। রাশেদ ভাই আঙ্গুলের ফাকে সিগারেট নিয়ে ঐ এক ঘ্যানঘ্যানানিই আওড়ে চলতেছে। সবাই এখন বেশ সচেতন, মনোযোগ দিয়ে শোনে। আসলামের ঘটনার পর তাকে আরও বেশি ভয় পায় ছেলেপেলে, এছাড়া তো কিছু করার নেই। নিজ হাতে নিজ দলের লোক খুন করে লাশ গুম তো করলই, এবং পরদিন ক্যাম্পাসে নাটকের মত বিক্ষোভ সমাবেশ সাজিয়ে দোষ দিল বিরোধী পক্ষের। এই মানুষ পলিটিক্স করবে নাতো কে করবে?
দরজা দিয়ে হঠাৎ রুমে ঢুকল পিয়াল দিপু। সব ঠেলেঠুলে টেবিলের দিকে আগাচ্ছে, পিয়ালের ডানহাত জ্যাকেটের ভিতর আড়াল করা। মিটিংয়ের মধ্যে এমন করায় কয়েকজন সিনিয়র গালি দিয়ে উঠলে রাশেদ ভাই ওদের দেখে। দাড়িয়ে কিছু বলার আগেই দিপু খুব হাসি হাসি ভাবে বলল, "কেমন আছেন ভাই, ভাল?"
পরপরই রুম কাপিয়ে ঠিক সেদিনের মত দুটো শব্দ হল, গুলির শব্দ। ঝিঁঝিঁদের ডাক হঠাৎ থেমে গেল যেন। রাশেদ ভাই ধপ্ করে চেয়ারে বসে যায়, বুক ভাসে গলগল রক্তে। রুমের সবাই দেখে, পিস্তল তখনো জাগিয়ে ধরে আছে পিয়াল। ঠোঁটের পাশে কৌণিক হাসি, চোখেমুখে কি কঠিন তৃপ্তির আনন্দ, সাথে দিপুরও। রাশেদের রক্তাক্ত শরীর দেখতে ভয়ানক মজা লাগছে। লাল খয়েরি ঘোরলাগা রক্ত।
৪।
মশার আক্রমণ রুখতে দিপুর ঠাসঠুস ননস্টপ চলছেই। পিয়ালের অবস্থা তো আরো বিচ্ছিরি। হাই তুলে মুখ একটু হা করলেই হল, একগাদা মশা সদলবলে ঢুকে পড়ে। আরে বাবা ঢুকবি ভাল কথা, চুপ করে থাক। নাহ্, গলার মধ্যে একদম ড্যান্স মারা শুরু। খালি সুড়সুড়ি লাগে। এই কথা দিপুকে বলতেই ফাজিলটা দম ফাটানো হাসি দেয়, খ্যাক খ্যাক খ্যাক! হাসতে হাসতে চাপড় মারে ফ্লোরে, বিশাল মজা পাইছে। ওর এমন জোকার মার্কা হাসির চোটে পিয়ালও শুরু, কাটা ঠোঁটের ব্যাথা গায়েই লাগে না। অন্ধকার রুমের চারকোণায় এখন খালি হাসির শব্দ। আচমকা দিপু থেমে গেলে দেখাদেখি পিয়ালও।
- কিরে কি হইল তোর?
- দোস্ত মশা খাইয়া ফালাইছি তো! ওয়াক, বমি আসতাছে।
- আমি তো তোর আগে খাওয়া শুরু করছি। চাবাইলে কুছকুছ শব্দ হয়, যেন চানাচুর খাইতেছি। চাবা বেটা, হেব্বি টেস্ট।
- বাহ্ ভাল তো, মশার দামে চানাচুর পাইলাম, ভাল না?
এই আবার শুরু। ফাজিল দুইটার হাসাহাসি আর দেখে কে। একজনের গায়ে আরেকজন ধাক্কা খেয়ে খেয়ে হাসছে; মুগ্ধ হয়ে দেখার মত একটা জিনিস।
হাসির ফাকেই একসময় খেয়াল করে রুমের দরজা খুলেছে, তিনটা ছেলে ঢুকল। ওপাশ থেকে আসা হালকা আলোয় কারো চেহারা ঠিকমত বোঝা যায় না। কিন্তু তারা যে ওদের পাগলাটে হাসি দেখে হতচকিয়ে গেছে এটা ঠিকই বোঝা যায়। অতঃপর আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই টানা কয়টা বুলেট এসে সুনসান নিরব করে ফেলে সব। কিছুক্ষন আগের হাসিতে কাপা রুমটা এখন একেবারে শান্ত।
পরিশেষঃ
রাজশাহী ভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের মারিয়া নামের মেয়েটাকে একা একাই দেখা যায় এখন। একা একা মাঠে বসে থাকে, একা একা ক্লাসে যায়, একা একা হলে ফেরে, একা একাই ঘোরে। মাঝে মাঝে শের-এ-বাংলা হলের দু'তলায় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে কথা বলে না। বিকেলে ফুচকা চটপটি গাড়িগুলোর কাছে গেলে সবার জমজমাট হাসিঠাট্টা কানে সহ্য হয় না, বড়বেশি মাথা ধরে। পার্কের সেই পুরনো পিচের রাস্তায় একপা দুপা তিনপা ফেলে শুন্য দৃষ্টি নিয়ে হেঁটে চলে অনেকদূর। হাঁটার তালে চোখের পানিগুলো তাই আকাবাকা ভাবে গড়ায়, কয়েকফোটা জমে থাকে ঠোঁটের কোণে। গলার শিরা-উপশিরা ফুলিয়ে চিৎকার করে ডাকতে ইচ্ছে হয়, "পিয়াল! আসলাম! দিপু! আমাকে একটু মুটকি বলে ডাক, একটু হাসিয়ে দিয়ে যা। আমার যে খুব হাসতে ইচ্ছা করে, খুব!"

Post Comment

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন