বাস-স্ট্যান্ড এ অনেক রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হচেছ, বিরক্ত লাগছে। অবশ্য সিলেট যাওয়ার সময় সব সময় বিরক্ত লাগে এনির,এতদিন হয়ে গেল তবু ক্যাম্পাস, হল এখনো খুব বেশি আপন হতে পারে নাই। বাসা থেকে যাবার সময় প্রতিবার মন খারাপ হয়। মোবাইল বাজছে, মনে হয় সবুজ ফোন দিচেছ। এই সময় ফোন দেয় কেন? বাসা থেকে বের হবার সময় তো বলছি একটূ পর বাসে উঠব। এই ছেলের ফোন দেয়ার কোন ঠিক ঠিকানা নাই, কখনো তিন চার দিন কোন খোজ নেই, কোন ফোন নেই, আবার কখনো তিন চার মিনিট পর পর ফোন। ফোনটা রিসিভ করল এনি,
এনি, হ্যালো;
সবুজ, কই তুমি;
এনি, কই আবার থাকব, বাস-স্ট্যান্ডে ; তোমারে না একটু আগে বললাম বাস-স্ট্যান্ডে যাই ১০ টার বাসে সিলেট যাব;
সবুজ, ও হ্যাঁ, বলছিলা তো আছা যাও। রাখি।
সবুজ ফোন টা রেখে দিল। বাস এখনো আসে নাই আরেকটু কথা বললে কি হতো। কিন্তু এই ছেলে এমনি ,কখন এনি তার সাথে কথা বলতে চায়, কখন এনি তাকে একটু কাছে চায় কখনই বুঝে না । মাঝে মাঝে মনে হয় এই ছেলের সাথে তার যে সম্পর্ক তা যে কিসের এনি নিজেও জানেনা।
আপাতদৃষ্টিতে বর্তমানে বলা যায় তারা প্রেমিক-প্রেমিকা। এনির বন্ধুরাও কিছুটা confused তারা দুজন দুজনকে কি ভালবাসে নাকি তারা একে অপরের শত্রু!! কারণ কেউ তাদের কখন কোন প্রেমিক প্রেমিকা সুলভ আচরণ করতে দেখে নাই। ফোনে যদি এনি অনেকক্ষন ধরে কথা বলে তাহলে বুঝতে হবে তারা মনের মাধুরী মিশায় ঝগড়া করছে, তাদের দেখলে মনে হয় প্রেম করার সবচেয়ে মোক্ষম কারণ আর উদ্দেশ্য একটাই ঝগড়া করা। আর ঝগড়া করে তারা দুজনেই অনেক আনন্দিত থাকে, যেদিন তাদের ঝগড়া হয়না সেদিন দুজনেরই মনে হয় কি যেন বাদ পরে গেছে, এনির বন্ধুরা মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে “ আচ্ছা সবুজ কি তোকে আসলেই ভালবাসে?? হাসি পায় এনির, হ্যাঁ অন্নদের boyfriend দের মত সবুজ তাকে সিলেট পৌঁছে দেয়না, তাকে প্রতি মাসে দেখতে আসেনা, তাকে জান, সোনা-পাখি , বাবু-মনি বলে ডাকে না, এমনকি প্রতিদিন ফোনও দেয়না। এমনকি আজ পর্যন্ত তার হাতটাও ঠিকমত ধরে নাই। সবুজ শুধু রাস্তা পার হবার সময় তার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখে তখন মনে হয় ছোট বেলায় বাবা ঠিক এমন করেই রাস্তা পার করে দিত। হাসি পেয়ে গেল এনির প্রেমিকের হাত ধরে হাঁটার সময় তার মনে পরে বাবার হাত ধরে হাঁটার কথা?? Good thought!!!
হাবিজাবি চিন্তা করতে করতে বাস চলে আসে। বাসে উঠে যায় এনি।এক ঘণ্টা হয়ে গেছে বাস চলছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এদিকে রাস্তা এত খারাপ একটু পর পর ঝাঁকুনি খাচ্ছে বাস।আচমকা বাসটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়ে একটা গাছের গুড়ির সাথে বাড়ি খেল। বাসের সামনের দিকের গ্লাসটা ভেঙ্গে গেছে। সামনের অনেক যাত্রী গুরুতর আহত। এনির তেমন কিছু হয়নি। কিন্তু সামনের যাত্রীদের অবস্থা দেখে তার কেমন জানি মাথাটা ঘুরে উঠল। সব যাত্রীদের অন্য একটা বাসে তুলে দেয়া হল। কিছুক্ষণ পরে একটা হোটেলের সামনে যাত্রা বিরতি দিল। এনির মাথাটা এখনো ঝিম ঝিম করছে, এনি ব্যাগ থেকে মোবাইল আর ১০০ টাকা নিয়ে বাস থেকে নামল। অনেকক্ষন ধরে হাতমুখ ধুল এনি। তারপর হোটেলের সামনে একটা গাছের নিচের সাথে লাগোয়া বেদিতে বসল। অনেকক্ষন ধরে সে এভাবেই বসে রইল। হটাত সম্বিত ফিরে সে দেখল বাস চলে গেছে। বাসে তার টাকার ব্যাগ, ল্যাপটপ এর ব্যাগ। ল্যাপটপ টা কিছুদিন আগেই কেনা হয়েছে, এনি computer science এর ছাত্রী। পড়াশোনার কাজে তার ল্যাপটপ সবসময় লাগে। মা সংসারের টাকা থেকে অনেক কষ্ট করে টাকা বাঁচিয়ে তাকে ল্যাপটপ টা কিনে দিয়েছিল। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে সে বারবার তাকে ল্যাপটপ কিনে দেয়া সম্ভব না, আর তার কাছে শুধু ১০০ টাকার একটা নোট আছে এটা দিয়ে তার এখান থেকে কোন খানে যাওয়া সম্ভব না। কি করবে এনি কিছুই বুঝল না, মাকে ফোন দিল, মা ফোন ধরছে না, মনে হয় কলেজে ক্লাস নিচ্ছে। সবুজকে ফোন দিল এনি,
সবুজ: হ্যালো...
এনি কান্না জড়ান কণ্ঠে বলল, আমি অনেক বিপদে পড়ে গেছি, এনি সবুজকে সব ঘটনা খুলে বলল।
সবুজ তখন তার মামার গাড়িটা নিয়ে ঢাকা- নারায়ণগঞ্জ রোডে ড্রাইভ করছিল সব শুনে সে বলল ,
তুমি ঐখানে থাক আমি এখুনি আসছি...। সবুজ দ্রুত গাড়ী ঘুরলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে।
প্রায় একঘণ্টার মত পার হয়ে গেছে, এনির ফোনে কান্নাকাটি করছিল দেখে ওর আশেপাশে ভিড় জমে গেছে অনেক দাদা, চাচা গোছের কিছু লোক তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে, সবুজ এখনো আসেনি।
রাস্তায় বিশাল জাম,হাইওয়ে রাস্তায় এত জ্যাম হবার তো কথা না। এনি ওখানে একা, ওর জন্যে চিন্তা হচ্ছে, মেয়েটা অনেক ভয় পেয়েছে, সামনে একটা বাস নষ্ট হয়ে গেছে সেকারণেই এত জ্যাম, আর এই জ্যাম ছাড়তে দেরি হবে...। সবুজ একটু চিন্তা করল, এনি যে হোটেল টার সামনে সেটা এখান থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে, সবুজ গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত হাঁটা ধরল, প্রায় পঁচিশ মিনিট পরে এনির কাছে পৌঁছল। এনি সবুজকে দেখে পুরাই কান্নাকাটি শুরু করে দিল বাচ্চাদের মত। সবুজ কোনমতে তাকে শান্ত করল এরপর তার এক দুলাভাইকে ফোন দিল, সবুজের দুলাভাই বাস মালিক সমিতির বড় কোন পোস্টে, তাকে ফোন দিয়ে অনেক ঝামেলা করে সেই বাসের হদিস বের করল যে বাসে এনির ব্যাগ, ল্যাপটপ সব ছিল। এনির ব্যাগ গুলেকে পরবর্তী একটা কাউন্টারে রাখার ব্যবস্থা করে সে এনিকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গাড়ির কাছে পৌঁছল।পরে রওনা দিল সেই বাস কাউন্টারের দিকে। এনির ব্যাগ গুলা সেই কাউন্টারে পাওয়া গেল। ল্যাপটপ টা ফিরে পাওয়াতে এনি কিছুটা সস্তি পেল, নয়ত মাকে সে কি জবাব দিত ভেবে পাচ্ছিল না।
ব্যাগ গুলো নিয়ে সবুজ ঢাকার দিকে রওনা দিল। ঘড়িতে প্রায় পাঁচটা বাজে, অনেক দেরি হয়ে গেছে,মামার গাড়িটা ফেরত দিতে হবে, এরপর এনিকে সিলেট পৌঁছে দিতে হবে। মেয়েটা বড়ই বিধ্বস্ত আর ক্লান্ত।ঢাকা পৌঁছতে প্রায় নয়টার মত বেজে গেল। মামার গাড়িটা ফেরত দিয়ে সবুজ সিলেট যাবার বাসের দুটো টিকিট কিনল রাত দশটার দিকে বাস ছাড়ল। এনি কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে গেল, সারাদিনের ধকলে বড়ই ক্লান্ত মেয়েটা, ওর ঘুমন্ত মুখটা দেখে বড়ই মায়া লাগল সবুজের। অঘোরে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। জীবনে অনেক মেয়ের সাথেই অনেক দুষ্টুমি অনেক মিথ্যা প্রেমের নাটক করেছে, কিন্তু এই মেয়েটার কাছে এসে ভালবাসার কাছে ধরা দিতে হয়েছে সবুজকে। তার আশেপাশের মেয়েদের থেকে একদমই আলাদা এনি। একইসাথে মেধাবী, নামাজি আর নিজের পরিবার আর আশেপাশের মানুষের জন্যে তার অনেক মায়া। এই মায়াবতীর সাথে যদি বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে তাহলেই সে খুশি। তার অগোছালো জীবনটাকে অনেকটা গুছিয়ে ফেলেছে এই মেয়েটা, যদিও ঝগড়া করতে করতে তাদের প্রেমের দুইটা বছর পার হয়ে গেছে। ওদের যখন কথা হয় তখনি সেটা ঝগড়ায় রূপ নিতে খুব বেশি সময় লাগেনা। তবে এত ঝগড়ার পর ও ভালবাসাটা কিন্তু ঠিক জায়গাতেই আছে। সে জানে আর আট দশটা প্রেমিকের মত সে এনির কাছে না থাকলেও এনি তাকে কখনই এত সহজেই ছেড়ে যাবেনা। আর একারণেই সে অনেকটাই স্বশ্তি অনুভব করে। একটা সম্পর্ক ধরে রাখার সবটুকু শক্তি আর ধৈর্য এই মেয়ের আছে।
ঘুমাতে ঘুমাতে এনি সবুজের কাঁধে মাথা রাখল, সবুজ খেয়াল করল এনির গায়ে অনেক জ্বর, মেয়েটা কাঁপছে, সে এক হাত দিয়ে এনিকে জড়িয়ে ধরল, কোণ কাঁথা কিংবা চাদর আছে কিনা এনির ব্যাগে কে জানে। হাতড়ে হাতড়ে এনির ব্যাগে একটা ওড়না পেল, সেটাই ওর গায়ে জড়িয়ে দিল।
একটু পরে বাস একটা হাইওয়ে রেস্তরায় থামল। এনির ঘুম থেকে ততক্ষণে উঠে গিয়েছে। সবুজের কাঁধে নিজের মাথা আবিষ্কার করে এনি একটু লজ্জা পেল।
সবুজ বলল, তুমি ত ভয়ে জ্বর বাধায় ফেলছ...।
এনি, হুম ...।।
সবুজ, চল যাই কিছু খাই অনেক খিদা লাগছে,
হাইওয়ে রেস্তরার নাম উজান ভাটি। ওরা রেস্তরার দোতলায় উঠে গেল।সবুজ ভাতের অর্ডার দিল।
এনি বলল ভাত খেতে অনেক সময় লাগবে বাস মিস হয়ে যেতে পারে।
সবুজ হাসল, বলল একবার বাস মিস হওয়াতে মনে ভয় ঢুকে গেছে তাইনা, অসুবিধা নাই এখন আমি আছি কিছু হবেনা।
এনি বলল, এহ কি আমার পাবলিক সে থাকলে কিছু হবেনা, মনে হয় তুমি সুপার হিরো!!
সবুজ, হাহ... এই জামানায় উপকারের দাম নাই।
এনি, ভাতই কেন খেতে হবে হালকা কিছু খাও
সবুজ, নাহ... সারাদিন যে ধকল গেছে তাতে ভাত ছাড়া আর কোন কিছুতেই আমার পোষাবে না।
কি আর করা... এই ঘাউড়া ভাত খেয়েই ছাড়বে।এনি আর কিছু বলল না। এনির কিছু খেতে ইচ্ছা করছিল না কিন্তু সবুজ জোড় করে ভাত খাইয়ে ছাড়ল, খেয়েদেয়ে নীচে এসে তাদের আজকের দিনের শেষ নাটকের দর্শন করতে হল, বাস চলে গেছে!!!!!!!
সবুজ বলল, বাস না বলল বিশ মিনিট থামবে আমরা কি বিশ মিনিটের বেশি দেরি করে ফেলছি???
এনি ঝাঁঝিয়ে উঠল, গামলা ভইরা গোগ্রাসে ভাত গিলবা আর বাস তোমার জন্য বইসা থাকবে না!!!!! আর বেশি করে ভাত খাও আমি বলছিলাম, এখন ভাত খাওয়ার দরকার নাই, বাস বেশিক্ষণ থামবে না, আমার কথা তো শুনো নাই...আর বৃষ্টিও নামবে মেঘ ডাকতেছে!!!!
সবুজ বলল, আছা অসুবিধা নাই এবার তোমার ল্যাপটপ তো সাথে করে নিয়া নামছি...আর ঢাকা-সিলেট এ এক ঘণ্টা পরপর বাস যায়। হোটেলের সামনের কিছু লোক এসে বলল, আপনারা কোথায় ছিলেন আমরা তিনবার মাইকিং করছি!!!!
এনি কড়াভাবে সবুজের দিকে তাকাল, সবুজ নির্বিকার ভাবে লোকগুলোকে জিজ্ঞেস করল, পরের বাসটা কখন?
তারা বলল, এক ঘণ্টা পর।
আর কি করা হোটেলের সিঁড়িতে গিয়ে বসল দুজন, আর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল তখন। দুজন বৃষ্টি দেখতে লাগল আর বাসের জন্য অপেক্ষা...। রাত তিনটা বাজে, সকাল বেলাও এমনি এক হাইওয়ে হোটেলে বসে এনি ভয়ে অস্থির ছিল কিন্তু এখন এত রাতে এই ঝুম বৃষ্টির মধ্যেও তার কোন ভয় লাগছে না...। এই বিশাল মানুষটা পাশে থাকার কারণেই কি এতটা নির্ভার লাগছে... এই নির্ভরতা আর স্বস্তির নামই কি ভালবাসা??? এনি জানেনা...
সবুজের সাথে তার প্রথম দেখা বাস-স্ট্যান্ডে ...তাদের পরিচয় হয়েছিল ফোনে... সবুজ অবশ্য তাকে আগে থেকেই চিনত ...কিন্তু সে চিনত না। কুমিল্লা থেকে সিলেট যাবার সময় একদিন বাস-স্ট্যান্ডেই সবুজ হটাত করেই ফোন দিয়ে বলল, আমি বাস-স্ট্যান্ডে , তোমার সাথে দেখা করতে আসছি। এনি তো অবাক!! মানে কি বলা নেই কওয়া নেই হুট করে এসে হাজির সে তো জানেও না এই ছেলে দেখতে কেমন??? হটাত দেখল একটা আধবুড়ো লোক তার দিকে এগিয়ে আসছে।এনির একবার মনে হল পালায়। পালানর উদ্যোগ মোটামুটি নিয়েও ফেলেছিল তক্ষুনি সামনে এক বিশাল আকারের ছেলে এসে হাজির...কে জানত এই বিশাল আকারের ছেলে টা তার মনের একটা বিশাল অংশ দখল করে নিবে। এই ছেলেটা তার সাথে তথাকথিত কোন প্রেমিক পুরুষের মত তার সাথে আচরণ করেনা আর তার মধ্যেও অত পুতুপুতু প্রেমিকা স্বভাব নেই। এনি শুধু এই মানুষটাকে বাকিটা জীবন তার পাশে দেখতে চায়...সবসময় এই মানুষটার পাশে এতটাই নির্ভার অনুভব করতে চায়। অবশেষে বাস চলে আসল, তারা আবার বাসে উঠে বসল। আর কোন বাস মিস না করে অবশেষে তারা সিলেট এসে পৌঁছল। এনি হল গেঁটে নামিয়ে দিয়ে সবুজ চলে গেল। মায়া লাগল এনির অনেক ...নাহ...এই বিশাল হাতিটা তাকে সত্যিই অনেক ভালবাসে।
****************************************************************************
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন