শনিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

তারার দেশের রানী.......

তারার দেশের রানী.......
(১) আচ্ছা, জীবনে প্রথমবার বাবা হওয়ার অনুভূতিটা কেমন? অবশ্য, অনেকদিনের অপেক্ষার ফসল তো ভালোই হওয়ার কথা। কিন্তু, সেই অনুভূতির ছোঁয়া পাওয়ার জন্যে অপেক্ষার সময়টা? এই সময়টা বোধ হয় সবচেয়ে উৎকণ্ঠায় কাটে! হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দুশ্চিন্তায় নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসছিলো আমার! বারবার শুধু সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করছিলাম। শান্তাকে ওরা ভেতরে নিয়ে গেছে। কিন্তু, কোন খবর এখনো দিচ্ছে না কেন? ঘড়ি দেখলাম। মাত্র পাঁচ মিনিট হয়েছে! অপেক্ষার ক্ষেত্রে সময়টা হয়তো, সবসময় থমকে দাঁড়ায়! নিকোটিনের প্রচণ্ড অভাব বোধ করছি এই মুহূর্তে! হাসপাতালের ভেতর দাঁড়িয়ে সিগারেট খাওয়া সম্ভব না। কিন্তু, দুশ্চিন্তার কারণে বাইরেও যেতে পারছি না। আর সেই একই কারণেই হয়তো, ঘামতে শুরু করলাম! হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে! গলাটাও শুকিয়ে আসছে আমার! আমার অবস্থাটা বুঝেই কিনা কে জানে...... মা বলল, “বাবা, তুই বাইরে থেকে একটু ঘুরে আয়। এতো চিন্তা করিস না। আল্লাহ্ ভরসা। আর আমি তো আছিই এখানে।” মায়ের কথায় যেকোনো সন্তানই সত্যিকার ভরসা পায়। অনেক দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়েও তাই একটু সময়ের জন্যে বাইরে বেরিয়ে আসলাম। যাক, ভালোই হল। এই ফাঁকে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলা যাবে। ধূমপায়ী মানুষ মাত্রই জানে, দুশ্চিন্তায় সিগারেটের ভূমিকা কেমন! ঠিক এই সময়, দৃশ্যটা চোখে পড়লো আমার! সাইরেন বাজাতে বাজাতে একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে থামলো হাসপাতালের গেটে। হঠাৎ, শুরু হল সবার প্রচণ্ড ব্যস্ততা! অজ্ঞান হয়ে যাওয়া রোগীকে নামিয়ে আনলো স্ট্রেচারে করে। তড়িঘড়ি করে নিয়ে যাচ্ছে ইমারজেন্সি রুমের দিকে। রোগীর মুখের দিকের চোখ পড়তেই থমকে গেলাম আমি......... রূপা!!! চোখে পুরু কাঁচের চশমা দেওয়া একজনকে দেখলাম। মোটাসোটা শরীর। ভদ্রগোছের চেহারা। বোঝাই যাচ্ছে, যথেষ্ট ধনী। সম্ভবত, রূপার স্বামী। রূপার মত মায়াবতী মেয়েদের স্বামী তো এমনই হওয়া উচিৎ! বেচারার অবস্থা দেখে আমারই খারাপ লাগতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর পর চোখ মুছছে। আমার মত স্বার্থপর না এই লোকটা। রূপাকে হয়তো অনেক ভালোবাসে। চোখের এই জল নিখাদ ভালোবাসার না হয়ে পারে না! এই কান্না তো আমিই চিনবো! ভালোবাসার কান্না যে আমার জীবনেও একবার এসেছিলো.........

(২) রূপার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। সহপাঠী ছিলাম আমরা। হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, “ছেলে এবং মেয়ের মাঝে কখনোই বন্ধুত্ত হতে পারে না। তারা প্রেমে পড়বেই। হোক তা অল্প সময়ের জন্য।” হয়তো তাই, আমাদের বন্ধুত্তের সম্পর্কটাও প্রেমে গড়াতে বেশি সময় নেয় নি। আমাদের বোঝাপড়াটা ছিল অন্যরকম। পরিচয়টাকেও তাই আমরা অনেক মূল্যবান ভাবতাম। পরস্পরের কাছে আসাটাকেও সৌভাগ্য মনে করতাম নিজেদের। চোখে অনেক স্বপ্ন ছিল। ভাবতে ভালো লাগতো, পরিণত স্বপ্নের পরবর্তী অংশের কথা! বাদাম খেতে খেতেই তাই একদিন ঠিক করে ফেলেছিলাম, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের নামটাও...... ছেলে হলে “রাতুল” আর মেয়ে হলে “রাত্রি”। কে জানে! বাস্তব পরিণতির কথা ভাবি নি বলেই হয়তো, স্বপ্ন দেখার সাহস পেতাম অনেক বেশি! থমকে যাওয়া স্বপ্নের রূপ দেখতে পেলাম তৃতীয় বর্ষে থাকাকালীন। একদিন আমাকে ফোন করে খুব দ্রুত ক্যাম্পাসে চলে আসতে বলল রূপা।
সেদিন যখন সামনে থেকে দেখলাম ওকে, মনে হচ্ছিলো এতোদিনের রূপার মুখের দীপ্তি কোথায় যেন বাধা পাচ্ছিলো! আহত হৃদয় আর মলিন মুখে ও আমাকে বলেছিল, “রাশেদ, আমাদের সম্পর্কের পরিণতি কী হবে?”
-হঠাৎ, এই প্রশ্ন?
-বাসা থেকে বিয়ের জন্যে খুব চাপ দিচ্ছে! বাবা খুব তাড়াতাড়ি আমার বিয়ে দিতে চান। এই কারণেই তোমাকে ডাকা। আমার বাবা খুব রাগী একজন মানুষ! তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের সম্পর্কের কথা বলার মত সাহস আমার নেই।
-এখন?
-জানি না, কী হবে। তুমি কিছু একটা করো।
-তোমার বোঝা উচিৎ, আমি মাত্র তৃতীয় বর্ষ পড়ুয়া একটা ছেলে। লেখাপড়ার পাট শেষ হতে আরও অনেক সময় বাকি! এই অবস্থায় আমি চাকরীর চেষ্টা করাটা হবে বোকামি। তুমি যেভাবে পারো, বিয়েটা আপাতত ঠেকাও। আমার পক্ষে এখন কিছু করা সম্ভব না। ব্যাপারটা একটু বুঝতে চেষ্টা করো।
-ভালোবাসার মানুষটাকে কাছে পাওয়ার জন্যে যদি চেষ্টাই না করলে, তবে কেন ভালোবেসেছিলে আমাকে?
-আচ্ছা, আমি কীভাবে জানব তোমার বাবা কবে তোমার বিয়ে ঠিক করবেন? তাছাড়া, ক্যারিয়ারের জন্যে আমার অনেকদূর পর্যন্ত লেখাপড়া করার ইচ্ছে। তুমি কি চাও না, আমি অনেক উপরে উঠি? -তুমি কি আমার দিকটা একটুও ভাববে না?
-এই অবস্থায় আমি-ই বা আর কী করতে পারি?
-একটা কাজ করি চল। আমরা পালিয়ে যাই!
-আমি কখনোই চাই না, এমন একটা কাজ করে সবার সামনে আমার মা-বাবাকে ছোট করতে। -আমার উত্তর পেয়ে গেলাম আজ। আর কিছুই বলার নেই। তবে, তৈরি থেকো......... আমাকে বিদায় জানানোর জন্যে! ভালো থেকো! একথা বলেই, কাঁদতে কাঁদতে চলে গিয়েছিলো রূপা।
চোখে ঝাপসা দৃষ্টি নিয়ে, বড় কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে অনেকক্ষণ বসে ছিলাম আমি। আমার মত দুখের পর্বত বুকে নিয়ে হয়তো গাছটাও সেদিন কেঁদেছিল। হয়তো, তার হৃদয়েও রক্তক্ষরণ হয়েছিলো। তাই বোধ হয়, সেদিনের কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলো বেশ লাল মনে হয়েছিলো! কিছুই করতে পারি নি আমি। রূপার অশ্রুসিক্ত পথের শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে, ওর চলে যাওয়া দেখলাম। জীবনে প্রথমবারের মত আমার চোখে এসেছিলো...... ভালোবাসার কান্না! চলে গিয়ে যেন আরও অনেক কাছে চলে এসেছিলো সে। বুঝিয়ে দিয়ে গেছে আমাকে......... ভালোবাসার বিশালতা! সেই ছিল রূপার সাথে আমার শেষ দেখা। আর কখনো দেখা হয় নি, হয় নি কথাও!
(৩) ফোনে কথা বলতে দেখলাম লোকটাকে অনেক দূর থেকেই। আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বলেই হয়তো, তার দিকে চোখ পড়ছিল আরও বেশি! কী কথা বলছিল, জানতে খুব ইচ্ছে হল আমার! খানিকটা এগিয়ে গেলাম তার দিকে। এখন পরিষ্কার ভাবে সব শোনা যাচ্ছে। যতটুকু বুঝলাম, রক্ত লাগবে! অপরিচিত কোন লোকের সাথে আলাপ জমানোর দক্ষতা আমার অনেক পুরনো। সেটাই কাজে লাগালাম।
-স্লামালাইকুম।
-ওয়ালাইকুম সালাম। আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না!
-আমাকে আপনি চিনবেন না ভাই। আসলে এই হাসপাতালে আমার স্ত্রী আছে। অসুস্থ; প্রেগন্যান্ট ও। অপারেশন থিয়েটারে। আপনাকেও অনেক চিন্তিত দেখাচ্ছে! তাই ভাবলাম......
-ও আচ্ছা।
-আপনি যদি কিছু মনে না করেন, আপনার রোগী.........?
-আমার স্ত্রী। বাসাতেই ছিল। সে-ও প্রেগন্যান্ট। কিন্তু সিঁড়ি থেকে হঠাৎ, পা পিছলে নিচে পড়ে গিয়ে.........! এই কথা বলার পর তার চোখের জল আড়াল করার চেষ্টা চোখে পড়লো। আমারও যে কান্না আসছে। কিন্তু, কাঁদতে পারছি না। গলায় তীব্র কষ্টের একটা সূক্ষ্ম যন্ত্রণা অনুভব করছি! -ডাক্তার কী বলল ভাই?
-এই মাত্র বলে গেলো, ওর নাকি অনেক ব্লিডিং হয়েছে। এখনো কিছু বলা যাচ্ছে না। আঘাতটা নাকি গুরুতর। রক্ত দরকার। কিন্তু, কোথাও রক্ত পাচ্ছি না। সম্ভাব্য সবখানে ফোন করলাম। আশার কথা কেউ শোনাতে পারছে না। কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না ভাই। এদিকে, আমার ছেলেটাও নাকি মায়ের জন্যে বাসায় অনেক কান্না-কাটি করছে! কিন্তু আমি তো জানি না, ওকে.........!
আবার চোখ মুছতে দেখলাম তাকে। মানুষটাকে দেখে অনেক মায়া হচ্ছে আমার! কী করে বুঝাই, রূপাকে নিয়ে যে আমার বুকের মাঝেও অনেক তোলপাড় হচ্ছে!
-বয়স কত আপনার ছেলের?
-পাঁচ।
-কী নাম ওর?
-রাতুল। এমন একটা অবস্থায় ছেলের নাম জানতে চেয়ে লোকটাকে বোধ হয় একটু বিরক্তিতে ফেলে দিলাম আমি। কিন্তু, ছেলের নামটা শুনেই বুকে একটা ধাক্কা খেলাম! রূপা কি তবে আজও মনে রেখেছে.........?
-কিছু মনে করবেন না। আপনার স্ত্রী’র ব্লাড গ্রুপ কী?
-ও নেগেটিভ। বিধাতা বোধ হয় নিয়তি এভাবেই লিখে রেখেছিলেন। আমারও যে একই গ্রুপ!
-কী আশ্চর্য! আমার ব্লাড গ্রুপও তো একই! আপনি যদি কিছু মনে না করেন, আমি রক্ত দিতে পারি। কথাটা শুনেই চোখের তারা জ্বলজ্বল করে উঠলো ভদ্রলোকের!
-প্লিজ। আমাকে আর লজ্জা দেবেন না। আমি আপনাকে ঠিক বোঝাতে পারবো না, এই মুহূর্তে আমার অনুভূতিটা কেমন! আপনার কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকবো ভাই! আর দেরি করি নি। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, অল্প সময়ের জন্যে হলেও আমার মাথা থেকে শান্তার চিন্তা উবে গিয়েছিলো!
(৪) হাসপাতালের বেডে শুয়ে আমি তাকিয়ে আছি লাল রক্তে ভরা ব্যাগটার দিকে। যে ভালোবাসা আমি পেয়েছিলাম রূপার কাছ থেকে, লোহিত কণিকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফোঁটার মাধ্যমে তা ফিরিয়ে দেওয়ার হাস্যকর এক বৃথা চেষ্টা করছি! ঘুমিয়ে থাকা রূপার মুখটা দেখতে আজ অনেক মায়া লাগছে আমার! সেই পুরনো দিনের মত! আচ্ছা, ও কি জেগে উঠবে? অবাক হয়ে দেখবে, কোন মানুষটি আজ তার পাশে? জানতে পারবে কোনদিন, কার শরীরের রক্ত ওর শরীরে গিয়ে শুদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে? নাকি ঘৃণা করবে আমাকে, ওকে ফিরিয়ে দেওয়ার অপরাধে? কী এক অদ্ভুত বেদনায় মনটা ভরে উঠলো আমার! কত কাছে আজ রূপা! তবুও, তাকে ছোঁয়া যাচ্ছে না! ওর কাছ থেকে পাওয়া এতোটা ভালোবাসা...... ফিরিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না! মনে হচ্ছে, আমাদের মাঝে যেন যোজন যোজন দূরত্ব! আচ্ছা, নীরব কান্না কাকে বলে তা কি রূপা জানে? ও কি জানে, মনের দহন কী? মানুষ মাঝে মাঝে অনেক কিছুই আগে থেকে বুঝতে পারে! এই ব্যাপারটা ঠিক এই মুহূর্তে কেন আমার মাথায় আসছে জানি না। তবে কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে, আমি মেয়ের বাবা হতে যাচ্ছি! আমার মাথায় শুধু একটা নামই ঘুরছে......... “রাত্রি”।
রাত্রি নাকি কখনো সূর্যকে পায় না! তবে কি আমার আর রূপার জীবনটাও তেমন হয়ে গেলো? সন্তানের নামকরণ নিয়ে মা-বাবার মধ্যে কোন কোন সময় একটু ঝামেলা হতে শুনেছি। আচ্ছা, শান্তা কি আমার দেওয়া নামটা রাখবে? ও কি জানতে চাইবে, মেয়ের নাম কেন “রাত্রি” রাখলাম? যদি জানতেই চায়, কী জবাব দেবো আমি? বের হয়ে আসতেই রূপার স্বামীর কৃতজ্ঞতা মাখা দৃষ্টি, বুকটা ভরে দিলো আমার! খুব অল্প সময়ের ব্যবধানেও যা বুঝলাম, মানুষটা আসলেই চমৎকার! রূপা অনেক ভাগ্যবতী, এমন একটা মানুষকে স্বামী হিসেবে পেয়েছে! আমাকে হয়তো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তিনি। তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আমিই বললাম, “এই যে দেখুন; এতক্ষণ ধরে কথা বলছি আমরা। কিন্তু, আপনার নামটাই তো এখনো জানা হল না!”
-ওহ সরি! আমি মারুফ হাসান চৌধুরী। আপনি? এতোটুকু বলেই তিনি হাতটা বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে। নিজের পরিচয়টা বলতে গিয়েও, কোথায় যেন বিবেক বারবার বাধা দিচ্ছিলো আমাকে! কারো নাম শুনলেই মানুষ তা মনে রাখার চেষ্টা করে। আমার মত মানুষকে মনে না রাখলেই বা ক্ষতি কী? তাই মাথায় ঘুরতে থাকা সব চিন্তা গোপন করে আমার দিকে বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরে বললাম, “ভাই, আমার নামটা না জানলে কি খুব বেশি ক্ষতি হবে? জীবনে কোন কোন মানুষের আগমন হয়, শুধুই চলে যাওয়ার জন্যে! না হয় থাকলাম আপনার কাছে, কোন এক অপরিচিত মানব হয়ে! ভালো থাকবেন। আসি।”
এইটুকু বলেই চলে আসলাম! পেছনে না তাকিয়েও পরিষ্কার বুঝতে পারছি, চোখে অবাক দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে মানুষটা! আপাতত অনেক দূরে কোথাও চলে যেতে হবে আমাকে। নিজেকে একটু সময় দেওয়া দরকার এই মুহূর্তে...... একান্তই নিজের মত করে!
(৫) অনেকক্ষণ পর বাইরে থেকে ঘুরে এসে হাসপাতালে শান্তার কেবিনে ঢুকলাম আমি। ঢোকার সাথে সাথেই মায়ের স্নেহ মাখা বকুনি হয়তো কপালে ছিল আমার। আজ অনেক খুশি আমার মা! আমাকে দেখেই বলে উঠলো, “তুই কী বলতো? এতক্ষণ কোথায় ছিলি? তুই না বাবা? মেয়ে হয়েছে তোর! তাড়াতাড়ি আজান দে!” শান্তার লাজুক আর মলিন মুখটা দেখেই বুঝতে পারছি, অনেক ধকল গেছে ওর উপর দিয়ে। নারী জাতি আসলেই অনেক ত্যাগী। বিধাতা হয়তো তাদের তৈরিই করেছেন ত্যাগ আর মায়া দিয়ে সবাইকে বেঁধে রাখার জন্যে। মা জাতটা অনেক কিছু বুঝতে পারে! আমাদের একান্ত কিছু সময়ের দেওয়ার জন্যেই হয়তো মা রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। আজান দিলাম। এরপর, ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম শান্তার দিকে। জীবনে প্রথমবারের মত আমার মধ্যে বাবা হওয়ার সত্যিকার অনুভূতি টের পেলাম! কোলে তুলে নিলাম আমার বংশের প্রথম প্রদীপকে! শান্তার চোখের তারা জ্বলজ্বল করছে! ওকে বললাম, “শান্তা।”
-বল।
-তোমাকে অনেক ধন্যবাদ!
-কেন?
-আমার সন্তানের মা হওয়ার জন্যে! মুচকি হেসে উঠলো শান্তা। হয়তো, সে আমার কথা শুনে খুব অবাক হয়েছে! আনন্দে আত্মহারা আজ ও! আমি যেমন বাবা হয়েছি, শান্তাও তো তেমনি মা হয়েছে! খুশি হওয়াই তো স্বাভাবিক।
-আচ্ছা, ওর নাম কী রাখা যায় বল তো? অনেক উৎসাহী হয়ে বলে উঠলো সে! কে জানে! আমার নাম রাখার সময় আমার মায়ের মুখটা দেখতে নিশ্চয় এমনই ছিল!
-ওর নাম রাখলাম, “রাত্রি”।
-রাত্রি?
-হুম। জানতে চাইলে না, “রাত্রি” নামটা কেন রাখলাম?
-আমি তো জানি। চমকে উঠলাম আমি!
-কেন?
-রাতে ও আমাদের কাছে এসেছে বলেই হয়তো “রাত্রি”! চোখের জল আর লুকিয়ে রাখতে পারলাম না আমি। শান্তা অবাক হয়ে আমাকে দেখছে!
-তোমার চোখে পানি কেন? জানতে চাইলো শান্তা।
-আমি যে ভালোবাসি!
-রাশেদ! তুমি তো কখনো আমাকে বলো নি...... বুকটা ধক করে উঠলো আমার! এরপর কী বলবে শান্তা? ও কি তবে......
-কী?
-আমাকে যে এতো ভালোবাসো! একটু চুপ থেকে, নীরবতা ভাঙলো শান্তা।
-“ভালোবাসি বলেই তো ভালোবাসি বলি নি”! হেসে উত্তর দিলাম আমি। শান্তাও কাঁদতে শুরু করলো। আমার একটা হাত অনেক মায়ায় জড়িয়ে ধরে রেখেছে ও। আচ্ছা, শান্তা মেয়েটা আমাকে এতো ভালোবাসে কেন?
(৬) আজকের পত্রিকার শোক সংবাদটা আমার মাথায় এখনো ঘুরছে। রূপা আর নেই! হ্যাঁ, আমার রূপা আর নেই! চলে গেছে না ফেরার দেশে! হতে পারে, ওকে আমি “আমার” বলার মত কোন অধিকারই নেই। অবশ্য, শান্তাকে নিয়ে হাসপাতাল ছেড়ে আসার পর রূপার আর কোন খোঁজ নেই নি আমি। নিতে পারি নি। সত্যি বলতে, ওর সামনে আবার দাঁড়ানোর মত সাহস আমার ছিল না। নিজেকে অনেক অপরাধি মনে হচ্ছিলো! জানতাম, আঘাতটা ছিল গুরুতর। কিন্তু, ভাবি নি............!
শেষ পর্যন্ত, মৃত্যুর সাথে যুদ্ধে পেরে উঠে নি রূপা। কে জানে! আমার মত পিশাচের রক্ত শরীরে গেছে বলেই হয়তো, চলে গেছে ও...... সবাইকে কাঁদিয়ে! বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আছি আমি। রাস্তার পাশে হেঁটে হেঁটে একটা লোক চলে যাচ্ছে। তার সাথে ছোট্ট একটা ছেলে। বয়স কতই বা হবে? পাঁচ বছর! হয়তো, রাতুলের সমান। ছেলেটা হয়তো তার বাবার সাথেই কোথাও থেকে ঘুরে এসে এখন বাসায় যাচ্ছে। এক হাত দিয়ে বাবার হাতের একটা আঙুল ধরে আছে সে, আরেকটা হাতে একটা বেলুন। দু’জনই হাসি-খুশি। আচ্ছা, আমার মেয়েটাও কি এমন করে আমার সাথে বেড়াতে যাবে? আমার হাতের একটা আঙুল এভাবে পরম মমতায় মুঠোবন্দি করে রাখবে? হঠাৎ, হাতে ধরা বেলুনটা ছেলেটার হাত ফসকে চলে গেলো! গ্যাস বেলুন হবে হয়তো। চোখে করুণ দৃষ্টি আর তীব্র অনুশোচনা নিয়ে ছেলেটা তাকিয়ে আছে উড়ে চলে যাওয়া বেলুনটার দিকে! বাবা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। মানুষের জীবনটাও হয়তো এমনই। গ্যাস বেলুনের মতই উড়তে উড়তে এক সময় চলে যায়...... আকাশের ওপাড়ে! বারবার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে রূপার ঐ মায়াবী মুখ! মনটা আজ অনেক খারাপ! অনেক কষ্ট হচ্ছে! আমার যখন অনেক মন খারাপ থাকে, তখন একটা কাজ করি আমি। চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকি...... অনেক রাত! আমি একটা সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে আছি। হু হু করে বাতাস বইছে আর ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে সাগর পাড়ের ঐ বালির রাজ্য ভেঙে দিতে। জনমানবহীন চারিদিক। আশেপাশে কোথাও এক টুকরো আলো নেই। আলোর একমাত্র উৎস শুধু আকাশের পূর্ণিমার ঐ চাঁদটা! ভালোলাগার সুন্দর গানগুলো শুনতে শুনতে আমি কাঁদছি। যে কান্না দেখার কেউ নেই। অবশ্য, কিছু কিছু সৌন্দর্য এমন যে অল্পতেই কান্না পেয়ে যায়! আর থাকে কিছু কিছু পিছুটান। মনের একলা ঘরে স্মৃতির বাক্সে বন্দি হয়ে, যা রয়ে যায় আজীবন! কিছু কথা না বলাই রয়ে যায়! রূপাকে একটা কথা বলা হয় নি। সবসময় আমার নিজের ভেতর একটা বোধ কাজ করতো......আমিই শুধু মানুষকে ভালোবাসি। মানুষগুলো ভালোবাসতেই জানে না। রূপা চলে গিয়ে হয়তো আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেলো...... কেউ কেউ ভালোবেসে যায় গোপনে! যে ভালোবাসায় কোন খাদ থাকে না! যার সাক্ষী হয়ে থাকেন শুধু বিধাতা আর চিরকাল সত্যিকারের ভালোবাসার কাঙাল থাকা মানুষগুলো! শুনেছি, মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলে নাকি আকাশের তারা হয়ে যায়! আকাশে চাঁদের পাশে জ্বলজ্বল করে একটা তারা জ্বলছে। আচ্ছা, ঐ তারাটা কি রূপা? ও কি আমায় দেখতে পাচ্ছে? জানি না, এমন কেন লাগছে আমার! মনে হচ্ছে, মুচকি হেসে ও যেন আমাকেই বলছে ওর সেই প্রিয় কবিতার লাইনগুলো...... “হয়তো তোমায় হারিয়ে দিয়েছি, নয়তো গিয়েছি হেরে। থাকনা ধ্রুপদী অস্পষ্টতা, কে গেলাম কাকে ছেড়ে......” ওর কথা মনে করে বুকটা ভেঙে যাচ্ছে আমার! খেয়াল-ই করি নি, কখন চোখ থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আমাকে অনেক ভালোবাসতো রূপা! কখনো এতোটুকু কষ্ট পেতে দেয় নি! ও পাশে থাকলে হয়তো চোখের এই জল মাটিতেই পড়তে দিত না। না বুঝেই, একদিন ওকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম আমি। এখন অনেক কিছুই বুঝি। তাই, আর চাই না...... কেউ ফিরে যাক! আজ ওকে খুব বলতে ইচ্ছে করছে...... জানো রূপা? এই পৃথিবীর মানুষগুলো বড় নিষ্ঠুর। এরা সত্যিকার স্বর্গীয় ভালোবাসার রূপ কখনো দেখে নি! হয়তো, দেখবেও না কোনদিন। তবুও, ভালো থেকো তুমি...... চাঁদের আলোয় নিজেকে সাজিয়ে! গভীর রাতে যে চাঁদের আলোয় চিকচিক করে হয়তো জনম জনম ধরে জ্বলতে থাকবে...... কোন একজনের চোখ বেয়ে নেমে আসা ভালোবাসার কান্না! অনেক অনেক ভালো থেকো রূপা...... ভালোবাসার পরশ নিয়ে! ভালো থেকো তুমি...... চিরটাকাল আমার আকাশে, তারার দেশের রানী হয়ে...............
উৎসর্গঃ সেইসব মানুষগুলোকে......... যাদের অনেক কষ্ট দেওয়ার পরও নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে যায় আজীবন, যারা জানে কী করে ভালোবাসতে হয়, যারা জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে শেখায় ভালোবাসার মূল্য, যারা গল্পের নেপথ্যে থেকেই তৈরি করে......... হাজারও ভালোবাসার গল্প!

Post Comment

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন